তপ্ত রোদে একটানা ধান কাটার পর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তাঁরা দুজন। মেতে ওঠেন খুনসুটি আর নানা গল্পে। তবে তাঁদের গল্পের গোটাটাই জুড়ে ছিল ধান ও ধানের দাম নিয়ে। মজুর কার্তিক বর্মণ বলছিলেন, ‘ধানের বাজার শুধু বাড়িছে, আর বাড়িছে।’ তাঁর সঙ্গী আতাউর রহমান বললেন, ‘তাই তো দেখছু। কাল হাটত হাইব্রিড ধান গেইছে ১৭০০ টাকা বস্তা (দুই মণ)। জন্মেও হাইব্রিড মোটা ধানের এমন দাম পাইনি।’
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় এলাকায় ওই দুজনের সঙ্গে কথা হয়। ওই এলাকার চাষি আনোয়ারুল হক বিডি২৪লাইভকে জানালেন, গত কয়েক বছর হাইব্রিড জাতের আগাম ধান চাষ করে চাষি লোকসান গুনেছেন। গত বছর এই সময় প্রতি বস্তা ধান ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারেননি। এ বছর আমন ধানের উৎপাদন হচ্ছে একরপ্রতি (১০০ শতক) ৫৪ থেকে ৬০ মণ। খরচ হয়েছে ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকা
গত তিন-চার দিন রানীশংকৈল উপজেলার কয়েকটি হাট ঘুরে জানা গেছে, হাটজুড়ে ধানের প্রচুর সরবরাহ। ভ্যান ও নছিমনে করে হাটে ধান বিক্রির জন্য আনছেন চাষি। আগাম আমন ধান প্রতি মণ ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতি একরে উৎপাদিত ধান বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে ৪০ হাজার টাকার বেশি। ধানের আবাদ করে চাষি লাভবান হচ্ছেন। এই ধান কাটার পর জমিতে আগাম আলু চাষের সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরা।
উপজেলার নেকমরদ রবিবার হাটে ১০ মণ ধান বিক্রি করতে এসেছেন ভাংবাড়ি গ্রামের চাষি আবুল হোসেন তিনি বিডি২৪লাইভকে জানান, এবার চার বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে হালচাষ থেকে শুরু করে সার, কীটনাশক, সেচ ও কাটা-মাড়াই পর্যন্ত বিঘায় খরচ গড়ে প্রায় ৯ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে ফলন হয়েছে ১৮ মণ। ৯৫০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করে পেয়েছেন ৬৮ হাজার ৪০০ টাকা।
রানীশংকৈল উপজেলার রাতোর গ্রামের চাষি হায়দার আলী দুই বিঘা জমিতে আগাম আমন জাতের ধান আবাদ করেছেন। তিনি বিডি২৪লাইভকে বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম এবারের মতো আর কখনো পাউনি। প্রতিবছর এমন দাম হইলে পরিবার নিয়ে ভালোভাবে বাঁচিবা থাকিতে পারিমো।’
ওই গ্রামের চাষি সনাতন রায় বিডি২৪লাইভকে বলেন, ‘আমি সাধারণত আলু আবাদ করি। তাই বোরো আবাদের পর আলু চাষ করি। কয়েক বছর ধরে বোরো ও আলু চাষের মাঝে স্বল্পমেয়াদি হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করে আসছি। এ বছর ধানের ভালো দাম পেয়েছি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে এবার উপজেলায় ২১ হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে।এর মধ্যে কৃষকেরা ৫ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমিতে আগাম হাইব্রিড জাতের আমনের চাষ করেছেন। হাইব্রিড ছাড়াও উচ্চ ফলনশীল বিনা-১৭, ব্রি-৭৫, ব্রি-৮৭ জাতের ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। উপজেলায় এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজারের মত হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। উপজেলার কৃষকেরা এখন সেই ধান ঘরে তুলছেন।
গতকাল সোমবার সদর উপজেলার কাশিপুর ধর্মগড় রাতোর লেহেম্বা হোসেনগাঁও এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চাষিরা পাকা ধান কাটায় ব্যস্ত। কেউ কেউ আঁটি বাঁধছেন। কেউ আবার মাথায় করে ধানের আঁটি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। ধানের দাম বেশি পেলেও ফলন নিয়ে অনেক চাষির মধ্যে হতাশা রয়েছে।
ভরনিয়া গ্রামের চাষি কৃষ্ণ বর্মণ বিডি২৪লাইভকে বলেন, এবার কারেন্ট পোকার আক্রমণ ও বিভিন্ন রোগবালাইয়ের কারণে ধানের ফলন কমে গেছে। কিন্তু বাজারে ধানের ভালো দাম সেই কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় দেবনাথ বিডি২৪লাইভকে বলেন, ধান চাষ করে চাষি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এবার তাঁরা ধানের ভালো দাম পাচ্ছেন। কৃষকেরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পেলে ধানের আবাদ আরও বেড়ে যাবে, যা খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখবে।