দৈনিক নবতান
জনতার সংসদ

BREAKING NEWS

পর্যটকদের পছন্দের পণ্য এখন শুঁটকি

0

কক্সবাজার পর্যটন নগরী হওয়ায় দেশিবিদেশি পর্যটকের কাছে শুঁটকির চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। তারা ফিরে যাওয়ার সময় পর্যটন পণ্য হিসেবে শুঁটকি নিয়ে থাকে।

গত সপ্তাহে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় শুঁটকিকে ‘পর্যটন পণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তারা নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।

খাবার তালিকায় ভোজন রসিকদের কাছে শুঁটকিকে সুস্বাদু হিসেবে রাখা হয়। শুঁটকির আাচার ও পথ্য হিসেবে ব্যবহারে দিনদিন সুনাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তারা দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছেন অর্গানিক শুঁটকির প্রতি। লবণ-বিষ ও কেমিক্যালমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুস্বাদু এ শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ভোক্তাদের চাহিদামত প্যাকেজিং করে বাজারজাত করা হয় স্বাস্থ্যসম্মত এ শুঁটকি।

উৎপাদনের কোনো পর্যায়েই লবণ-বিষ-ফরমালিন অথবা অন্যান্য ক্ষতিকর কেমিক্যালের ব্যবহার করা হয় না। তাই মাছের প্রাকৃতিক স্বাদ ও মান বজায় থাকে।

সুস্বাদু ও মানসম্মত এ শুঁটকি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে দেশ-বিদেশের পর্যটক ও ভোক্তাদের মাঝে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মী দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদিত হচ্ছে সামুদ্রিক লইট্টা, ছুরি, সুরমা, রূপচান্দা, কালিচান্দা, ফইল্লা, চিংড়ি ও ফাইস্যা মাছের শুঁটকি।

মশামাছি ও কীটপতঙ্গ নিরোধক এ ডায়িং হাউসে প্রাকৃতিক সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণ করে মাছ আর্দ্রতামুক্ত করা হয়। শেষে সাত থেকে আট দিন ন্যাচারাল সানড্রাইয়ে শুকানোর পর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াজাত হয়ে গেলে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফ্রিজারে সংরক্ষণ করা হয়।

প্রথম পর্যায়ে সমুদ্র থেকে আহরণ করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মান যাচাই করে সংগ্রহ করার পর প্রথমে ভালভাবে পরিষ্কার করা হয়। এরপর প্রাকৃতিক হলুদ-মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত পানিতে ১০ মিনিট চুবিয়ে রাখা হয়। তারপর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বিশেষভাবে নির্মিত নেটের বেস্টনী ঘেরা ঘরে রাখা হয়। ফলে ভোক্তাদের মাঝে সাড়া জাগিয়েছে অর্গানিক শুঁটকির প্রতি।

কোনো ধরনের রাসায়নিক ছাড়াই কেবলমাত্র সূর্যের আলোয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদন করতে শুরু করে লইট্যা, ছুরি, চিংড়ি, রূপচাঁদা, টুনা, মলাসহ অন্তত ২২ প্রজাতির মাছের শুঁটকি। আর এর ভেতর দিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের সঙ্গে চেষ্টা করেন শুঁটকি থেকে মানুষের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্রস্তুত ও ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে অর্গানিক শুঁটকির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। শুঁটকি বর্তমানে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিওএফপি) ছাড়াও আমেরিকা ও কানাডাতেও রপ্তানি হচ্ছে।

অর্গানিক শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তারা বলেন, সচরাচর পচনরোধে শুঁটকিতে কীটনাশক ও ওজন বাড়াতে লবণ ও বালু ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পিউরিটির শুঁটকিতে এসব করা হয় না। শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে আমরা কেবলমাত্র সূর্যের তাপের মাধ্যমে শুঁটকি উৎপাদন করি। এসময় শুঁটকির চাংগুলো প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা থাকায় মশা-মাছিও বসতে পারে না। অর্গানিক উপায়ে উৎপাদন করা হচ্ছে শুঁটকি শুকানোর পর শুঁটকি উন্নত প্রযুক্তির ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে প্যাকেটজাত করা হয়।

প্যাকেটের সময় ভেতরে অক্সিজেন থাকলে পোকা বা জীবাণু জন্ম নেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু পিউরিটির শুটকিতে সেই ঝুঁকি নেই। এছাড়া এতে করে শুঁটকি দীর্ঘদিন সতেজও থাকে। এ কাজে কারিগরি সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।

মাছ সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ করা হয় কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম ফিশারি ঘাট থেকে বিভিন্ন সামুদ্রিক কাঁচা মাছ সংগ্রহের মাধ্যমে। জাতিসংঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থা প্রতি মাসে হাজার হাজার কেজি শুঁটকি সংগ্রহ করে। সেসব শুঁটকি কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

সাধারণ উপায়ে উৎপাদিত এক কেজি ছুরি মাছের শুঁটকির দাম ৮০০ টাকা হলে এক্ষেত্রে দাম পড়ে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১৬০০ টাকা। প্রতি কেজি লইট্টা দুই হাজার, মলা এক হাজার ও লাখ্যা মাছের শুঁটকির দাম পড়ে চার হাজার ৮০০ টাকার মতো।

দামের ব্যাপারে ২০০ গ্রামের একটি ছোট লইট্টার প্যাকেটেই ৪০ থেকে ৪২টি মাছ ধরে। অন্যদিকে সাধারণভাবে উৎপাদিত লইট্টার ৫০০ গ্রামের বড় প্যাকেটেও ধরে একই সাইজের ৪০ থেকে ৪৫টি শুঁটকি। প্রায় সব মাছের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে। ফলে হিসাব মেলালে দামেও খুব একটা তারতম্য থাকে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, অর্গানিক শুঁটকি নিরাপদ।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার ৫০টির অধিক শুঁটকি মহালে শ্রমিকেরা কেউ বড় বড় শুটকি পানিতে ধুয়ে নিচ্ছে, কেউ কেটে রোদে শুকাচ্ছেন। তারপর বাঁশ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ঘেরগুলোতে পসরা সাজানো হয়েছে নানারকম মাছের। এখানে ছুরি, লইট্যা, পোপা, ফাঁইস্যা, লাক্কা, মাইট্যা, রূপচান্দা মাছসহ বিভিন্ন ধরনের শুটকি উৎপাদন করা হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় পুরোদমে চলছে শুটকি উৎপাদন।

মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত স্বর্ণদ্বীপ খ্যাত সোনাদিয়া, শহরের নাজিরারটেক বৃহৎ শুঁটকি মহাল, খুরুশকুল, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফের বাহারছড়া ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের শুটকিমহাল কেবল বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, এগুলো এক একটি পর্যটন স্পটও বটে।

সোনাদিয়ার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দেশের ২০ শতাংশ শুটকি এখান থেকে উৎপাদিত হয়। এখানকার শুটকি তরতাজা মাছ কেটে করা হয় এবং এতে কোনো ধরনের ক্ষতিকর কীটনাশক কিংবা পাউডার মেশানো হয় না। মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের সোনাদিয়া দ্বীপে শুটকি মাছ উৎপাদনের ধুম পড়েছে। জীব বৈচিত্রসমৃদ্ধ একটি অনন্য সুন্দর দ্বীপ। দ্বীপটির আয়তন সাত বর্গকিলোমিটার।

কক্সবাজার শহর থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মহেশখালী চ্যানেলের মহেশখালী দ্বীপের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সোনাদিয়া বঙ্গোপসাগর ঘেষে অবস্থিত সোনাদিয়ার চর। এই চর এলাকায় হাজার হাজার জেলে ক্ষণস্থায়ী আবাস তৈরি করে ফিশিংকৃত মাছ শুকিয়ে, শুটকি মহাল তৈরি করে কোটি কোটি টাকার মাছ দেশে বিদেশে রপ্তানি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

ঢাকার বনশ্রী থেকে বেড়াতে আসা মারুফ-উম্মে সালমা দম্পতি জানান, কক্সবাজারে এলে অবশ্যই শুটকি নিয়ে যেতে হয়। আমাদের নিজেদের জন্য নয়, পুরো স্বজনদের জন্য নিতে হয়। তাই ২০ কেজি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিছি। এগুলো সবাইকে দেয়া হবে।

শহরতলীর নাজিরারটেকের শাহ আমানত ট্রেডার্সের মালিক আমান উল্লাহ আমান জানান, প্রতি সপ্তাহে তিনি নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে সপ্তাহে গড়ে কয়েক টন শুটকি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে থাকেন। অর্গানিক শুঁটকি উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র তার শাহ আমানত ট্রেডার্স বলেও জানান। সেখান থেকে শুটকি সারা দেশে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।

দেশের বৃহৎ শুঁটকি মহাল নাজিরারটেক। এখান থেকে শুঁটকি চাহিদা মেটানো হয় অনেকাংশে। তার শুঁটকির মান ভালো হওয়ায় সরকার এই প্রথম শুঁটকি খাতে আমান উল্লাহকে জাতীয় মৎস্য পুরস্কার দেয়।

অন্যদিকে কক্সবাজার জেলার উপকুলীয় এলাকা মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ, খুদিয়ারটেক, আলী আকবর ডেইল, আমজাখালী, পশ্চিম ধুরুং, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, সেন্টমার্টিন, জালিয়াপাড়া, সদর উপজেলার খুরুশকুলসহ বিভিন্ন উপকুলীয় এলাকায় বিপুল পরিমাণ শুটকি তৈরি হয়ে থাকে।

এখানে রাতদিন কাজ করছেন শুটকি শ্রমিকরা। বর্তমানে প্রতি কেজি রূপচাঁদা ১২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা, মাইট্যা ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা, কোরাল ৯০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, পোপা ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা, চিংড়ি এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা, লইট্যা ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা, ছুরি ৬০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, অন্যান্য মাছ ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে।

জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, নাজিরারটেক ও সোনাদিয়ায় শুটকি উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনার জায়গা। এ ব্যাপারে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় সুবিধা দেয়া হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.