মো. সেলিম হোসেন, গোপালপুর-টাঙ্গাইল:
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন নিয়ে’র স্বপ্নদ্রষ্টা মোঃ আশরাফুল আলম হান্নান বিভিন্নভাবে পা হারানো শতাধিক হত-দরিদ্র প্রতিবন্ধীদের মাঝে বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজন করে পুনরায় দু’পায়ে হাঁটার স্বপ্ন পুরণ করে দিয়েছেন। এতে করে পা হারানো দরিদ্র মানুষগুলো নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে পুনরায় জীবন সংগ্রাম শুরু করেছেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার এসব প্রতিবন্ধী মানুষ এখন দেশের বোঝা না হয়ে নিজ কর্মদক্ষতায় দেশের সম্পদে পরিণত হচ্ছে। বিত্তবানদের সহযোগিতায় ‘স্বপ্ন নিয়ে’ সাভারের সিআরপি ও কৃত্রিম হাত, পা ও ব্রেইস সংযোজন কেন্দ্র ‘ইজি লাইফ ফর বাংলাদেশ’ এর মাধ্যমে এসব কৃত্রিম পা সংযোজনের ব্যবস্থা করে। ধাপে ধাপে এ কাজগুলো করতে সাথে থাকেন সিআরপির কৃত্রিম পা সংযোজন বিভাগের প্রধান এস এম ইমরান সোয়েব, ‘স্বপ্ন নিয়ে’র পরিচালক (প্রশাসন) মীর তানভীর আহমেদ, সদস্য রাকিবসহ সংশ্লিষ্টরা।
বিনামূল্যে কৃত্রিম পা বিতরণ ও সংযোজন প্রসঙ্গে ‘স্বপ্ন নিয়ে’র প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, আমরা প্রায়ই আমাদের চারপাশে পক্ষাঘাতগ্রস্থ অসহায় মানুষ দেখে থাকি। এই মানুষগুলো যেনো কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন, তাদের জীবন-যাপন যেন আরো সহজ ও সুন্দর হয়, সে লক্ষেই ‘স্বপ্ন নিয়ে’ এ উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করতে সিআরপি কর্তৃপক্ষসহ যারা আমাদের সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমরা গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশেষ করে তিনি ধন্যবাদ ও কৃসজ্ঞতা জানান ইজি লাইফ ফর বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিউটি ও পরিচালক মোঃ মনিরুল ইসলাম দম্পতিকে।
জানা যায়, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন নিয়ে’র যাত্রা শুরু। লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার উদ্যমী তরুণ ব্যাংকার আশরাফুল আলম হান্নান সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পেশায় ব্যাংকার হলেও সামাজিক কাজ করার মাধ্যমেই চিত্তের আনন্দ অনুভব করেন। প্রতিনিয়ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার এসব মহতী উদ্যোগ দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘স্বপ্ন নিয়ে’র সার্বিক কর্মকান্ড নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ৫৫০-৬০০ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করে এই সংগঠনে। এতে দেশ-বিদেশের বিভিন্নজন নানাভাবে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। শুরুতে লক্ষ্মীপুর জেলাব্যাপী স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম চললেও বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় এর পরিধি বিস্তৃত। করোনাকালে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, নোয়াখালী জেলা ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানের মানুষকে খাদ্য সহায়তা থেকে শুরু করে অক্সিজেন, মাস্ক, পিপিইসহ নানা সহায়তা দিয়েছে সংগঠনটি। ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আনাই সংগঠনের লক্ষ্য বলে জানান তিনি। তার উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে রামগতি বি বি কে পাইলট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮৩ বছরের ইতিহাসে অসাধারণভাবে প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়েছে।
‘স্বপ্ন নিয়ে’ প্রায় ৪০ এর অধিক ছাত্র-ছাত্রীকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেট অফিসে শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পডুয়া শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে করে দেওয়া হয়েছে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা। চাকরির ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে অনেককে। হাজার হাজার মানুষকে করে দিয়েছে রক্তের ব্যবস্থা। হান্নান নিজেও রক্ত দিয়েছেন ২১ বার।
শতাধিক ব্যক্তির কৃত্রিম পা লাগানো, মাদকবিরোধী প্রচারণা, রক্ত সংগ্রহ করে দেওয়া, তিনটি বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নির্মাণ, অসহায়দের হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা, প্রবীণদের জন্য স্বপ্ন নিয়ের নির্ভরতার লাঠি উপহার, গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুক কর্নারের জন্য বই দেওয়া, দরিদ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দরিদ্র, মেধাবী ও দূর থেকে আসা ছাত্রদের সাইকেল উপহার, স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাতা বিতরণ, স্কুলে বৈদ্যুতিক পাখা উপহার, দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে পোশাক বিতরণ, রিকশাচালক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রেইনকোট বিতরণ, বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তিদের চিকিৎসা চালানো, দুরারোগ্য ব্যাধিতে যারা ভুগছেন- তাদের অপারেশনের ব্যবস্থা করা সংগঠনটির কাজের মধ্যে অন্যতম।
এ ছাড়াও রামগতি ট্র্যাজেডিতে অগ্নিদগ্ধদের প্রতিদিন ১০-১২ ব্যাগ প্লাজমা এবং প্লাটিলেটের ব্যবস্থা, ওষুধ, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো, রোগীদের স্বজনদের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবকরা। চিকিৎসা চলাকালে তাদের পরিবারের জন্য গ্রামের বাড়িতে ২০ দিনের খাবার ও ঈদসামগ্রী দেওয়া হয়েছে।
স্বপ্ন নিয়ের দুর্দান্ত প্রকল্প ‘স্বাবলম্বী প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে ২৪ জনকে স্বাবলম্বী করা হয়েছে, বেড়িবাঁধ এলাকা পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দিয়ে পরিচ্ছন্ন রাখা, শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ, মাদরাসা ও এতিমখানায় কোরআন বিতরণ, উপকূলীয় এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি, অসচ্ছল ছাত্র-ছাত্রী এবং পথশিশুদের মধ্যে ঈদের পোশাক বিতরণের মতো দৃষ্টান্তমূলক কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
করোনাকালে ৩ হাজার ৭০০টি অসহায় পরিবারের মধ্যে ৩ লাখ ১০ হাজার বেলার খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে ‘স্বপ্ন নিয়ে’। নন-এমপিও ৪৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১২০ জন আয় বঞ্চিত অসচ্ছল শিক্ষককে এবং ২১ বিধবাকে দিয়েছে রমজানের এক মাসের খাদ্য সহায়তা। এ ছাড়াও সংগঠনটি ২২০ জন চিকিৎসক ও সাংবাদিককে দিয়েছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), বিনামূল্যে অক্সিজেন সাপোর্ট, জনসাধারণের জন্য ১২টি হ্যান্ডওয়াশ ব্লক স্থাপন, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হ্যান্ডওয়াশ সামগ্রী ও লিফলেট বিতরণ, জীবাণুনাশক ছিটানো, দোকানের সামনে দূরত্ব চিহ্ন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাউন্সিলিং ও সাবান বিতরণ, বিভিন্ন স্থানে ব্যানার স্থাপনসহ নানা সচেতনতামূলক কাজ করেছে স্বপ্ন নিয়ে। গত কয়েক বছরে স্বপ্ন নিয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কয়েক লাখেরও বেশি মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছেন।
ঢাকায় এবং নোয়াখালীতে চিকিৎসার জন্য অথবা চাকুরী এবং ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আগতদের জরুরিভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছে ‘স্বপ্ন নিয়ে’। আশরাফুল আলম হান্নান আরো বলেন, আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো প্রান্তিক নারী-পুরুষদের কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে স্বাবলম্বী করা। ইচ্ছা আছে অসহায়দের জন্য অ্যাম্বু লেন্সের ব্যবস্থা করা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার। এই মানবিক কাজে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে বলে জানান তিনি।