দৈনিক নবতান
জনতার সংসদ

৭নভেম্বার ঐতিহাসিক মহাবিপ্লবের নাম

0
হাফেজ শাহ্ মিজানুর রহমান তালুকদার হারুন
শেখ মুজিবের দেশপ্রেম ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাই অখ্যাত জিয়াকে বিখ্যাত হওয়ার পথ তৈরী করেদেয়।
না হয়, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণাদিলে জিয়ার সেই সুযোগের প্রশ্নই আসতোনা আবাব পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধ পরিচালনা করলে তো গণ ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবেই হতো জিয়া না। আসলে জিয়ার মেধা, সাহসীকতা, আত্মবিশ্বাস, দেশপ্রেম সর্বোপুরী তার ভাগ্য ইতিহাসের সর্বোচ্চ চুড়ায় পৌঁছাতে সাহায্য করে। তবে ৭নভেম্বারের ঘটনা পুঞ্জিতে জাসদের অংশগ্রহণ অস্বীকার করা যেমন সম্ভবনয় তেমনি বিদেশি মদদ ছিলনা সেটা বলাও অসম্ভব।
কিছু বিতর্কিত আলোচনা বাদদিলে ৭ নভেম্বর এদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক উজ্জ্বল, চেতনায় ভাস্বর গৌরবের অনন্য দিন। তবে এটাও সত্য যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এর মূল্যায়ন এক রকম নয়। কারো কাছে নন্দিত, আবার কারো কাছে নিন্দিত। বিশেষকরে জাসদ, আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মধ্যে এ দিনটির মূল্যায়ন ভিন্ন ভিন্ন, যার মূলে রয়েছে নিজেদের ভুল কর্মকান্ড, অবুঝ চেতনা, নিজেদের প্রাপ্তি, রাষ্ট্র এবং জনগণের স্বার্থচিন্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মিত্র-অমিত্র নির্বাচনে মতদ্বৈধ।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এ দেশে শুধু সরকারের চরিত্র নয়, রাষ্ট্রের আদর্শগত চরিত্রেরও মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। সেদিন প্রকৃত অর্থেই একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়। সেদিনের কাহিনী ছিল সম্পূর্ণ নতুন। একটি বিপ্লবে যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সবই বিদ্যমান ছিল তাতে।
‘বিপ্লবে ইতিহাসের গতিধারা হঠাৎ করে নতুন এক মোড় নেয় এবং সূচনা হয় সম্পূর্ণ এক নতুন কাহিনীর, যে কাহিনী এর আগে জানা যায়নি বা বর্ণিত হয়নি।’ ওই বিপ্লবের মাধ্যমেই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে পাদপ্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ‘রাখাল রাজা’খ্যাত জেনারেল জিয়াউর রহমান।
১৯৭১ সালের মার্চে এ দেশের স্বাধীনতাপাগল মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত করে তিনি যখন বললেন, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি…সেদিন তিনি চট্টগ্রাম সেনা ছাউনির এক অখ্যাত মেজর মাত্র। কিন্তু ওই একটি ঘোষণা তাঁকে অমরত্ব দিল, অন্তর্গত করে নিল ইতিহাসের শীর্ষস্থানের। আওয়ামীলীগারদের ক্রোধের কারণ প্রথমত এখানেই, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ব্যর্থতা ও পরবর্তিতে রক্ষীবাহিনীর সমালোচনা দিয়ে জিয়ার জীবনি স্তব্ধ করা কোনতেই ও কোনদিন সম্ভব নয় তবু চেষ্টা কিন্তু অব্যাহত। সঙ্গত কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল দায়িত্বটি পালন করার কথা ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামীলীগের কিন্তু তারা সেখানে ব্যর্থ। মূলত এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ কথিত স্থপতি ও জনক শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও তাঁকে তার আসনে রাখতে তাজউদ্দিন আহমেদসহ অনেকের চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয় বিশেষ কারনে। যাক যে ঘোষণা ঘোষিত হওয়ার কথা ছিল শেখ সাহেবের কণ্ঠে তাই ভেসেউঠেছিল মেজর জিয়ার জবানিতে। আর সে সুবাধেই ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার ঘটে ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের অপর বিপ্লবের মাধ্যমে। মূলত এই ৭ই নভেম্বরের ঘটনাই মেজর জিয়াকে প্রেসিডেন্ট জিয়ায় রূপদান করে ও জন্মদান করে বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির।
৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না তা স্পষ্ট, অভ্যুত্থানের পূর্বনির্ধারিত কোনো নেতাও ছিলেন না। পরবর্তীকালে জিয়ার ওপর যদিও নেতৃত্ব অর্পিত হয়, তা ছিল মূলতই চলমান ঘটনার পরিণতি এবং সেনাবাহিনীতে তখন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের কোনো বিকল্পও ছিল না। ৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর- এই তিন দিন বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। খন্দকার মোশতাক তখন নামমাত্র প্রেসিডেন্ট।
খালেদ মোশাররফের পছন্দে বিচারপতি সায়েম ৬ নভেম্বর সকাল বেলা প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন। এই কয় দিন রেডিও-টেলিভিশন বন্ধ ছিল। ফলে দেশে কী ঘটছে, না ঘটছে কিছুই জানতে পারছিল না মানুষ। অর্থাৎ তখনকার সময়টা আজকের দিনেরমতো এতটা মিডিয়া বান্ধব ছিলনা। দেশে একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা শতভাগ সত্য ও বাস্তব। বঙ্গভবনের ‘মেজর গ্রুপের’ সঙ্গে আপস করে, তাদের সব বন্দোবস্ত করে নিরাপদে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেও ক্ষমতা সংহত করতে পারেননি খালেদ মোশাররফ। বলতেই হবে, ১৫ আগস্টের ঔরসে এবং ৩ নভেম্বরের গর্ভেই ৭ নভেম্বরের জন্ম আর ৭৫এর বছরটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্টাপাল্টা, ত্যাগ তিতিজ্ঞা অর্জন ও বিয়োজনের এক ঐতিহাসিক বছর। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবকে সিপাহি বিপ্লব বলা হয়, তারও বহু কারন আছে। আওয়ামী লীগ বলে ‘সৈনিক হত্যা দিবস’ তারও বহু নজির নিদর্শন আছে।
৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানকে যারা ‘সৈনিক-মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তাদের আহাজারির কারণ মানুষ বোঝে না এমনটা নয়।
৭ নভেম্বর যে মহানায়ককে ইতিহাস অমরত্ব দিয়েছে তার প্রতি সাবেক গণবাহিনী নেতা হাসানুল হক ইনু গংয়ের বিষোদ্গার যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানের আড়ালে ভিনদেশি প্রভুর স্বার্থরক্ষার জন্য ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ কিছু বিপথগামীর আর্তনাদ, তাও কিন্তু ইতিহাসে অজ্ঞাত নয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, সামরিক বিশ্লেষকদের মতামতের নির্যাস এমনই দাঁড়ায় যে ১৯৭৫ সালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘাত সৃষ্টির পেছনে দেশের ভেতর থেকে মহলবিশেষের উসকানি ছাড়াও সীমান্তের বাইরে থেকে ইন্ধন জোগানো হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বরের কুদেতার সাফল্য নিয়ে সংশয় দেখা দিলে সীমান্তের বাইরের চক্রান্তকারীরা তাদের ‘সেকেন্ড ডিফেন্স লাইন’কে সক্রিয় করে তোলে। খালেদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকদের ক্ষোভ আঁচ করতে পেরে জাসদের ‘গণবাহিনী’ এবং ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার’ কিছু লোক তাদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সঙ্গে ভিড়ে যায়। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মঈন তার স্মৃতিচারণে বিভিন্নভাবে এসব কথার উল্লেখ করেন, ‘৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরে ওপরে উল্লিখিতদের কয়েকজন রেডিও থেকে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার চালাতে থাকে যে কর্নেল তাহের হলেন সিপাহি-জনতার বিপ্লবের নেতা। কিছুক্ষণের মধ্যে সাধারণ সৈনিকরা গিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিলে বিপ্লবের বাণী সত্যিকারভাবে প্রচারিত হতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের এরপর জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তাঁকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক তৎক্ষণাৎ বাধা দেন। ফলে তখন জিয়াকে আর নেওয়া যায়নি। ব্রিগেডিয়ার হকের আশঙ্কা ছিল, রেডিও স্টেশনে নেওয়ার কথা বলে পথিমধ্যে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছিল ওরা।’ উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়াকে রেডিও স্টেশনে না পাঠিয়ে একটি রেকর্ডিং ইউনিটকে জিয়ার বাসায় নিয়ে আসা হয়। এভাবেই ওই শুক্রবার সকালে তাঁর রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করা হয়।
ইতিপূর্বে গ্রেপ্তারকৃত জাসদ নেতা মেজর (অব.) জলিল, আ স ম আবদুর রব ও মোহাম্মদ শাহজাহান মুক্তি পান ৭ নভেম্বর। মুক্তি পেয়ে তাঁরা জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামের উদ্দেশ্যে সৈনিকদের একত্র করার চেষ্টা চালান। এ উদ্দেশ্যে প্রচারপত্র ও লিফলেটে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা প্লাবিত করে দেওয়া হয়। বিপ্লবী ‘সৈনিক সংঘর্ষের’ ১২ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সৈনিকদের একত্র হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র জমা না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় বলেও উল্লেখ করেছেন ম্যাসকারেনহাস তাঁর ‘বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ’ গ্রন্থে। এভাবেই জেনারেল জিয়ার সঙ্গে গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংঘর্ষের মোকাবিলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায়। সেনা সদরের নিরাপত্তার জন্য জেনারেল জিয়া যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সপ্তম, নবম, একাদশ ও দ্বাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডো দলকে ৯ তারিখের মধ্যেই ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান ও পোশাকের প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ অবমাননাকর ‘ব্যাটম্যান’ প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন জিয়া। এতে জওয়ানদের মনোভাব সম্পূর্ণ পাল্টে যায় এবং জাসদের হঠকারী রাজনীতি ও ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড ব্যর্থ হয়ে যায়। এর পরই জাসদের বিরুদ্ধে সরকারি অভিযান শুরু হয় এবং মেজর (অব.) জলিল, আ স ম রব, হাসানুল হক ইনু ও কর্নেল তাহেরের ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফকে গ্রেপ্তার করা হয়।
৭ নভেম্বর, ৩ই নভেম্বার ১৫ আগস্টে যা হয়েছে ও যা ঘটেছে তারমূলে কিন্তু সেনা ও মুক্তিযুদ্ধারা। অন্য আমলা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অংশ গ্রহণ তেমন ছিলনা বললেই বলাযায়।
তবে এদেশের ইতিহাসে স্বচ্ছতার বিপরীতে অস্বচ্ছতার তিলকদাগ বরাবরই বড় ছিল যে কারণে ইতিহাসের সর্বত্র একটা অস্পষ্টতা মিশ্রিত।
বিঃদ্রঃ, আমার এ ক্ষুদ্র লেখাটি সম্পূর্ণ ইতিহাস আশ্রিত আর ইতিহাস জানার বিকল্পনেই। যে যত পড়বে সে তত জানবে। শুভ কামনা।
Leave A Reply

Your email address will not be published.