বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি বস্তিতে বসবাস করতেন মিনু। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। তাকে ছেড়ে গেছেন পঙ্গু রিকশাচালক স্বামী। বাবার বাড়িতেও তেমন কেউ নেই। একমাত্র ভাই মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নিতেন এই অভাবী মহিলার। মিনুর বড় ছেলে একটি মুদি দোকানের কর্মচারী, মেজোটা চায়ের দোকানে কাজ করতো ফুটফরমেয়াশির। অভাব লেগেই থাকতো তার পরিবারে। হত্যা মামলার আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমির প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন সহজেই।
কিছু চাল-ডালের লোভে অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ ও সহজ প্রকৃতির মিনু বিচারকের কাছে গিয়ে নিজেকে কুলসুম পরিচয় দিয়ে চলে যান কারাগারে। মিনুকে বলা হয়েছিল খুব দ্রুতই জামিনে মুক্ত করা হবে। সন্তানের পুরো দায়িত্ব নেবেন তিনি। কিন্তু মিনুর এই সরলতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান খুনের মামলার আসামি কুলসুম। এরপর ১৬ই জুন হাইকোর্টের আদেশে কারামুক্ত হন মিনু। কারাগারের বাইরের আলো বাতাসে ১৫ দিনও বাঁচতে পারলেন না মিনু।
গত ২৮শে জুন রাতে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ সংযোগ সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত হন মিনু। নিহত হলেও পরিচয় শনাক্ত হয়নি তখন। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে। কী দুর্ভাগা মিনুর জীবন। তদন্ত শেষে জানা যায়, তিনি সেই আলোচিত মিনু আক্তার। তার এই মৃত্যু নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে।
শনিবার (৩ জুলাই) রাতে নগরীর বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ২৮শে জুন রাতে বায়েজিদ লিঙ্ক রোডে আমরা গাড়ির ধাক্কায় নিহত এক অজ্ঞাত নারীর লাশ উদ্ধার করি। হাসপাতালে পাঠালে তার ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম অজ্ঞাত লাশ হিসেবে দাফন করে।
তিনি আরো বলেন, অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে আমরা আইনি সব পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। শনিবার আমাদের টিম সীতাকুণ্ডে গিয়ে ছবি দেখালে তার আপন ভাই রুবেল ছবি দেখে মিনুকে শনাক্ত করেন। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি জানান, ঘটনার রাতে টহল পুলিশ মিনুকে দুইবার সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। রাস্তায় তিনি লাফিয়ে লাফিয়ে মাতম করছিলেন।
এদিকে মিনুর মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় নাকি হত্যা সেটি পরিষ্কার করে জানতে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা। মিনুর পক্ষে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মোহাম্মাদ শিশির মনির বলেন, মিনুর জেল খাটার বিষয়টি যেহেতু উচ্চ আদালতে বিচারাধীন, তাই মিনুর মৃত্যুর কারণটি সুনিদির্ষ্টভাবে উঠে আসা উচিত। যদি মিনু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় সেটিও আসা উচিত। আবার অন্য কেউ যদি মিনুকে হত্যা করে থাকে সেটিও আসা উচিত। আমি এ বিষয়টি খুব তাড়াতাড়ি উচ্চ আদালতের নজরে আনবো।
মিনুর চট্ট্রগ্রামের আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ বলেন, আমার কাছে মিনুর মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে খটকা লাগছে। মিনুর মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ মিনুর জেলে যাওয়ার বিষয়ে অনেক কিছুই হয়ে গেল। এজন্য তার সড়ক দুর্ঘটনায় মুত্যুর বিষয়টি তদন্ত হওয়া দরকার। মিনু আসলেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, নাকি অন্য কেউ মিনুকে মেরেছে। তদন্ত করলে সঠিক বিষয়টি জানা যাবে।
মিনু সম্পর্কে আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ বলেন, ঘটনার মূল বিষয়বস্তু আলোচনায় আসে মিনুর শিশু মেয়ে জান্নাতকে কেন্দ্র করে। আড়াই বছরের জান্নাতকে ঘরে রেখেই কারাগারে গিয়েছিলেন মিনু। উপায়ান্তর না দেখে এতিমখানায় ভর্তি করানো হয় শিশু জান্নাতকে। কারাগারে যাওয়ার পর শিশু জান্নাতের খরচ চালাতে না পেরে এতিমখানা থেকে পড়া বাদ দিতে হয়। ছোট শিশু জান্নাতকে নিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন প্রতিবেশী একজন। ওই বাসায় জান্নাত অন্য শিশুদের সঙ্গে থাকতো। করোনাকালে একদিন মিনুর মেয়ের সঙ্গে পরিচয় তার সঙ্গে। তিনি তার পরিচয় জানতে চাইলে শিশুটি বলে আমার মা কারাগারে। কিন্তু কেন? এরপর বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামের কারাপরিদর্শক নথি ঘাঁটাঘাটি করে দেখেন কুলসুমির পরিবর্তে জেল খাটছেন মিনু। কারাগারে রাখা বালাম বইসহ অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে এমনটাই পাওয়া যায়। এরপর চট্টগ্রামের আদালতের হস্তক্ষেপে ধাপে ধাপে বের হয় মিনুর কারাগারে যাওয়ার বিষয়।
পরে এ মামলার উপনথি বিশেষ বাহকের মাধ্যমে পাঠানো হয় হাইকোর্টে। কয়েক দফা শুনানি শেষে গত ৭ই জুন মিনুকে কারামুক্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে আদেশের কপি চট্টগ্রামের আদালতে পৌঁছানোর পর ১৬ই জুন মিনু কারামুক্ত হন। কারামুক্ত হয়ে চলে যান আরফিন নগর ছিন্নমূল বস্তিতে। মিনু কারামুক্ত হলেও তার রেখে যাওয়া শিশু জান্নাত এরই মধ্যে মারা গেছে বলে জানিয়েছে আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ। মেয়ের মৃত্যু শোকে অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন মিনু। মারা যাওয়ার দুইদিন আগে তার ভাইয়ের বাসা থেকে বের হয়ে যান। এরপর থেকে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
মিনু যেভাবে কুলসুমি: ২০০৬ সালের ৯ই জুলাই মুঠোফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে চট্টগ্রাম নগরের রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পোশাককর্মী কোহিনুর বেগমকে হত্যা করা হয়। ২০০৭ সালের ২৬শে অক্টোবর ওই ঘটনায় কারাগারে পাঠানো হয় কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমিকে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ (চতুর্থ আদালত) আদালত থেকে ২০০৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পান কুলসুমি।
ওই মামলার রায় ঘোষণা করা হয় ২০১৭ সালের ৩০শে নভেম্বর। রায়ে কুলসুমিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১২ই জুন কুলসুমি সেজে আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান মিনু আক্তার। ২০১৯ সালের ৩০শে এপ্রিল বিচারিক আদালতের সাজার বিরুদ্ধে কুলসুমি হিসেবে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। এই আপিল হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ওঠে। মামলার নথি পর্যালোচনায় কারাগারের মহিলা ওয়ার্ড পরিদর্শনের সময় কুলসুমির বদলে মিনুর সাজা খাটার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। সূত্র: মানবজমিন