জীবিত ফলদ বা বনজ গাছ। কোনোটি মোটা আবার কোনোটি সরু। ঠায় দাঁড়িয়ে ডালপালা আর সবুজ পত্রপল্লব নিয়ে। এদের গা জুড়ে নানা বর্ণের কারুকাজ। যেন গাছগুলোকে পরানো হয়েছে নানা রঙের পাখি, ফুল-লতাপাতা ছাপানো নতুন জামা। মানুষ আকৃতির গাছে গাছে মানুষেরই ছায়া। যে ছায়া মানুষ আর বৃক্ষের মধ্যে প্রাণের বন্ধন ঘটিয়েছে। বলছিলাম গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরে রংধনুর আদলে গাছের গায়ে রং-তুলির খেলার কথা।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদ চত্বরে শতাধিক ছোট-বড় গাছে করা হয়েছে চিত্রকর্ম। উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শিবলী সাদিকের উদ্যোগে করা চিত্রকর্মগুলো ইতিমধ্যে লোকজনের নজর কেড়েছে। গাছগুলোর চিত্রকর্মে আছে হাজারো গল্প। আর এ গল্প মানুষের, এ গল্প প্রকৃতির, এ গল্প দেশের।
চিত্রশিল্পী আহসান হাবীব সাজুর আঁকা উপজেলা পরিষদ চত্বরে গাছের গায়ে রংতুলির খেলা এখন উপজেলায় আসা সেবাগ্রহিতা ও সেবাদাতা সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। গাছের গায়ে এ চিত্রকর্মে বিমোহিত হচ্ছে সাধারণ মানুষও। সাজুকে এ কাজে সহযোগিতা করেন স্থানীয় আরেক চিত্রশিল্পী উপজেলার দড়িসোম গ্রামের আয়নাল হোসেন।
উপজেলার পরিষদের বাসিন্দা সমবায় অফিসে কর্মরত আসাদুজ্জামান এরশাদ বলেন, পুরো উপজেলা চত্বর রঙিন সাজে সাজানো হয়েছে। দেখতে খুব ভালো লাগছে। সারাদিন কাজ করার পর মনে ক্লান্তি থাকলেও গাছের চিত্রকর্মগুলো দেখলে নিমিষেই ভালো হয়ে যায়।
উপজেলার পরিষদের আরেক বাসিন্দা শিক্ষক শাহানাজ আক্তার জানান, আসলে গাছের গায়ে রংতুলির আঁচড়ে উপজেলা পরিষদ চত্বরে অন্যরকম মাত্রা যোগ করেছে। দেখলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসে সেবা নিতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা মিয়া বলেন, ‘বয়স হয়েছে, তার পরও নানা রং-বেরংয়ের খেলা দেখলে সেই শৈশব-কৈশোরে ফিরে যাই। আমাদের ইউএনও সাহেবের উদ্যোগে মহিলাবিষয়ক অফিসের সাজু তার নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কাজটি করেছেন। খুবই ভালো লাগছে।’
স্থানীয় আর্টের দোকানি আয়নাল হোসেন এই কাজে সহযোগিতা করে আনন্দ পেয়েছেন বলে জানান। কালীগঞ্জে তার একটি আর্টের দোকান রয়েছে। নানা ধরনের সাইনবোর্ড বা দেয়াল লেখার কাজ করেন তিনি। আয়নাল বলেন, ‘গাছের গায়ে চিত্রকর্ম আঁকার কাজে সহযোগিতা করে খুবই মজা পেয়েছি। এই ধরনের কাজ এর আগে কখনো করিনি। গাছের গায়ে চিত্রকর্ম করার পর খুবই ভালো লাগছে। তবে রোজগারের জন্য নয় এ কাজ করে মনে হয়েছে প্রকৃতির জন্য কিছু করলাম।’
কথা হয় চিত্রশিল্পী আহসান হাবীব সাজুর সাথে। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতিতে গাছ আর মানুষের যে সম্পর্ক, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এসব চিত্রকর্মে। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, বাঁচবে পাখি ও জীবন। সৃষ্টির প্রতিটি জীবন একে অপরের সঙ্গে জড়িত।’
শিল্পী বলেন, ‘মানুষ যেমন একসময় বৃদ্ধ বয়সে এসে শেষ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি গাছগুলোও তাই। সে রেখে যায় তার বংশধর বা নিদর্শন। মানুষও তাই। গাছের অনেক দুঃখ আছে। যেগুলো সে প্রকাশ করতে পারে না। রংতুলির আঁচড়ে গাছের গায়ে কষ্টগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। মানুষেরও সেই রকম অনেক কষ্ট থাকে, অনেক কিছু সে প্রকাশ করতে পারে না।’
বর্তমানে কালীগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসে কাজ করেন তরুণ শিল্পী সাজু। বলেন, ‘আমরা সভ্যতার চরম শিখরে আরোহণ করেছি। কিন্তু বিবেককে এখনও জাগ্রত করতে পারিনি। প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি গাছ আর পরিবেশ। গাছ ধ্বংসের ফলে পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমি গাছের গায়ে রং দিয়ে গাছেরও জীবন-যৌবন আছে সেটা মনে করিয়ে দিয়েছি। আদি যুগে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হতো, ঠিক সেভাবে গাছকেও আজকাল হত্যা করা হচ্ছে।’
কালীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শিবলী সাদিক বলেন, রংধনু সবারই ভালো লাগে। আকাশে কালো মেঘের পর রংধনুর উদয় হয়। একটু আগে যে আকাশের কালো মেঘে মানুষের মন খারাপ হয়, কিছুক্ষণ পর সেই আকাশের রংধনুতেই মানুষের মন ভালো হয়ে যায়। তাই আমরা চেষ্টা করেছি এসব চিত্রকর্মে সাত রং ব্যবহার করতে। পৃথিবীতে যত কিছুই হোক আমার বিশ্বাস বাহারি রংয়ের খেলায় সবার মনই রঙিন হয়ে যায়।
শিবলী সাদিক বলেন, উপজেলায় বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্থানীয়দের সেবা প্রদান কাজে অনেক ব্যস্ত থাকেন। তাই সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে বাড়ি বা বাসায় ফেরার পথে উপজেলা পরিষদ চত্বরে রঙিন চিত্রকর্মের গাছগুলো দেখে সহজেই মন ভালো হয়ে যাবে। আবার অনেক সেবাপ্রত্যাশীর মন খারাপ থাকলে পরিষদ চত্বরে এসে তাদেরও মন ভালো হয়ে যাবে। উপজেলা পরিষদ চত্বরে রঙিন চিত্রকর্ম সবার মাঝে অন্যরকম প্রাণের সঞ্চার করবে বলেও মনে করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।